গত ১৭ মার্চ জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এক চিঠিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে অভিগমনের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে বলে ঘোষণা দেয়। ওই যোগ্যতা অর্জনের তিনটি শর্ত বাংলাদেশ এরই মধ্যে পূরণ করেছে। শর্ত তিনটি হচ্ছে—জাতীয় আয়, মানবসম্পদ ও জাতীয় ভঙ্গুরতা অতিক্রম করা। বাংলাদেশে গেল কয়েক বছরে দ্রুত মাথাপিছু আয় বেড়েছে—এ কথা সব মহল থেকেই বলা হচ্ছিল। আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন ঘটানোর দৃশ্যও চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সর্বনিম্ন সূচক ৩২ অনেক আগেই অতিক্রম করে ২৫-এ অবস্থান করছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালেই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন এ অঞ্চলের প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও অনেকাংশে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার কথা অমর্ত্য সেন উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটায় বৃহত্তর সমাজজীবন আধুনিকতার বলয়ে প্রবেশ করেছে। ডিজিটাইজেশনকে বাংলাদেশ যত দ্রুত গ্রহণ করেছে, এর প্রভাবে পরিবর্তনের দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধিত হয়েই চলছে। এমন বাস্তবতায় জাতিসংঘ কর্তৃক স্বপ্লোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের ঘোষণা বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাভাবিক স্বীকৃতিই মনে হয়েছে, কোনো ধরনের অতিরঞ্জন কিছু মনে হয়নি। যে জনগণের জীবন থেকে দারিদ্র্যের জীর্ণ-শীর্ণ-বিবর্ণ রূপ অনেকটাই বিদায় নিয়েছে, সমৃদ্ধির ছোঁয়া পড়েছে—সেই মানুষকেই বরং এখনো স্বপ্লোন্নত, দরিদ্র দেশের নাগরিক বললে অবাস্তব বলে মনে হতো। এখন বরং মানুষ জাতিসংঘের ঘোষণাকে বাস্তবতার স্বীকৃতি বলেই মনে করছে।
বিশ শতকের বিশ্বে অনেক ঘটনাই ঘটে গিয়েছিল, যা মানবসভ্যতার ইতিহাসকে নতুন মানদণ্ডে দেখা, বোঝা ও নির্ণয় করার সুযোগ পায়। এক শর কিছু বেশি দেশ ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পায়, স্বাধীন আত্মমর্যাদায় বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা সদ্যঃস্বাধীন দেশগুলোকে আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে নানাভাবে সাহায্য, সহযোগিতা, পরামর্শ, দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। ফলে বেশির ভাগ পিছিয়ে পড়া দেশ ও জাতি ধাপে ধাপে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করছে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকা একগুচ্ছ স্বাধীন দেশ নানামুখী চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার সহযোগিতা গ্রহণ করতে থাকে। একসময় বাংলাদেশের বাজেটের বড় অংশই ছিল আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার ঋণ ও সাহায্য নির্ভর। বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়নের আগে প্যারিস কনসোর্টিয়ামে অর্থমন্ত্রীকে হাজির হতে হতো, তাদের প্রেসক্রিপশনের বাইরে গিয়ে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা উপস্থাপন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। বাংলাদেশের সেই সময়ের নেতৃত্বের বড় অংশেরই উত্থান ঘটেছিল নানা সুবিধাবাদী গোষ্ঠী থেকে, দেশ ও জাতির ভেতর থেকে বেড়ে ওঠা রাজনীতি থেকে নয়। বিষয়টি বিদেশি দাতারা ভালো বুঝত বলেই ‘নাকে দড়ি’ দিয়ে টানা তাদের পক্ষে সহজ ছিল।
খুব নৈর্ব্যক্তিকভাবে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেই সময় স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যে বিদেশি সাহায্য ও ঋণ লাভ করেছিল তার কত অংশ প্রকৃত উন্নয়নে ব্যয়িত হয়েছিল, কত অংশ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিশেষের স্বার্থে, লুটপাটে ও বিদেশি নানা মহলের পকেটে চলে গেছে—সেই তুলনামূলক হিসাব কষলে আমাদের লাভের অংশ ছোটই বলতে হবে, বরং দেনার দায় বড় ছিল—এমনটি অস্বীকার করার উপায় নেই। এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন থেকে ভিশনারি-মিশনারি রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে দূরে ছিল, বঞ্চিত ছিল। আমাদের দেশে সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকেও উন্নয়নকৌশল নিয়ে বিতর্ক চলতে দেখা গেছে, মীমাংসায় পৌঁছার লক্ষণ কম ছিল। সেই সুযোগ নিয়েছিল আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও প্রভাব বিস্তারকারী দেশগুলো। অত্যন্ত সীমিত সুযোগ ও পরিসরে দেশের গার্মেন্ট এবং অন্য কিছু শিল্প যাত্রা শুরু করলেও অনুকূল পরিবেশের অভাব বাংলাদেশকে উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত গতি দেয়নি। তারপর দেশের শ্রমজীবী মানুষ ও উদ্যোক্তা শ্রেণি থেমে ছিল না, তারা অর্থনীতির গতি সঞ্চারে মুখ্য ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশ নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আর্থ-সামাজিক সেবা খাতে নতুনভাবে প্রণোদনা দিতে থাকে, বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীলতার চেয়ে আত্মনির্ভরতার নীতিতে পরিচালিত হতে থাকে। সে সময় বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নজির স্থাপন করে। খাদ্য উৎপাদন, সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নানা খাতে উন্নয়ন দৃশ্যমান হতে থাকে, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি দ্রুত ফলদায়ক হতে থাকে। তার পরও বাংলাদেশ ভাবতে পারেনি মঙ্গা ও ভঙ্গুরতা কাটিয়ে দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে উন্নত জীবনব্যবস্থা দানে সক্ষম হওয়ার গৌরব অর্জন করা সহজে সম্ভব হবে। বিশেষত ২০০৭-০৮-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ আমাদের জীবনকে কতটা হতাশায় নিমজ্জিত করেছিল—তা স্মরণ করতেই আঁতকে উঠতে হয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, দেশে উন্নয়নকৌশলকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্য নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় ব্যবচ্ছেদ ঘটা।
আমাদের মতো সমস্যাসংকুল দেশে গভীর প্রজ্ঞা ও মিশনারি-ভিশনারি নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা কত বেশি অগ্রাধিকার পাওয়া জরুরি সেটি অনেকাংশে মিসিং বা অনুপস্থিত। গতানুগতিক রাজনীতি, দল ও নেতৃত্ব দিয়ে এমন পশ্চাৎপদ দেশকে দ্রুত উন্নয়ন ধারায় যুক্ত করা মোটেও সম্ভব নয়। বলা চলে ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট দিনবদলের রূপকল্প জাতির সামনে উপস্থাপন করে একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করলেন। দেশের কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, ডিজিটাইজেশনের রূপকল্প ছিল অভূতপূর্ব। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে শেখ হাসিনা বাস্তবেই দেশের বিশৃঙ্খল খাতগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলে দেশের অর্থনীতির চাকা দ্রুত সচল হতে থাকে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে যুগান্তকারী পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, গ্রামীণ সমাজ-অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চারিত হতে থাকে।
গত ৯ বছরে বাংলাদেশের বেশির ভাগ খাতেই উন্নয়নের ধারা দ্রুত বিকাশমান। এ ধরনের পরিস্থিতিতেও চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে দূরত্ব পুরোপুরি কমে না, বাংলাদেশেও তাই ঘটেছে। বাংলাদেশ তার পরও বিদেশনির্ভরতা কমিয়ে পদ্মা সেতুর মতো বিশাল মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করে চলছে। দেশে এরই মধ্যে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, যেগুলোতে বাংলাদেশ নিজস্ব সম্পদ কাজে লাগাতে পারছে, বিদেশি সংস্থার ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা এখন প্রকল্প বাস্তবায়নে চূড়ান্তভাবে নেই। এখন বরং যৌথ অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের ধারা চলছে। দেশে এখন শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের মজুরি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি হারে বাড়ছে, নিম্ন আয়ের মানুষের পরিসংখ্যান তাই দ্রুত কমে আসছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আড়াই বছর আগেই নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করার স্বীকৃতি লাভ করেছে। এখন স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশের প্রাথমিক যোগ্যতা লাভের সনদ পেয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবে দেশটির বিকাশমান বাস্তবতার নানা চিত্র, দায়দায়িত্বও। সেটি ভালো বুঝতে হবে দেশকে যাঁরা নেতৃত্ব দেবেন তাঁদের। একই সঙ্গে জানতে ও বুঝতে হবে সাধারণ মানুষকেও। সেখানে ব্যত্যয় ঘটলে শুধু দেশের নামই কলঙ্কিত হবে না, সাধারণ জনগণও চরম আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণের যোগ্যতা অর্জনের যে স্বীকৃতি পেয়েছে তা যে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, তা হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করতে এখন দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনগণকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। এখানে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ যেমন রয়েছে, বিকাশের সুবিধাও সৃষ্টি হবে। অন্তত ছয় বছর আমরা যদি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করতে হবে, গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে, মানবসম্পদকে আমরা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারব, তত বেশি জাতিসংঘের মানদণ্ডে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের মহাসড়কে আমরা আস্থার সঙ্গে উঠতে সক্ষম হব। এ ক্ষেত্রে সেই ভিশনারি-মিশনারি নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই, যাঁরা দিনবদলের অঙ্গীকারে মাত্র ৯ বছর আগে আমাদের উজ্জীবিত করেছিলেন। বর্তমান চ্যালেঞ্জটি আরো কঠিন। সুতরাং নেতৃত্বের দৃঢ়তা, ভবিষ্যৎ দেখা ও পরিচালনা করার কোনো বিকল্প নেই। উন্নয়ন ও নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা একদিকে যেমন অপরিহার্য, অন্যদিকে মানদণ্ডের শর্ত পূরণে ব্যাপক আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে নেতৃত্বকে নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিতে হবে, তাহলেই টার্গেট পূরণে বাংলাদেশ কিছুতেই পিছিয়ে যাবে না। কেননা জনগণ পরিবর্তনের সুফলই শুধু ভোগ করতে নয়, বরং এর মূল নিয়ামক শক্তিরূপে ভূমিকা রাখতে চায়। বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালে যেভাবে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে স্বাধীনতার স্বপ্ন লাভ করেই ক্ষান্ত থাকেনি, যুদ্ধ করে তা ছিনিয়ে এনেছে, রূপকল্প ২০০৮-এর পরও মানুষ আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে অংশ নিয়েছে, ভবিষ্যতেও নেবে—এটি অনেকটাই পরিষ্কার। রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই এখন সুদৃঢ় অবস্থান নিতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, patwari 54@yahoo.com
Powered by : Oline IT