অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে দেশত্যাগে বারিত (বিরত রাখা) করার প্রয়োজন হলে এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট আইন বা বিধি প্রণয়ন এখন সময়ের বাস্তবতা’ বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একব্যক্তির বিদেশ যাওয়ার ওপর দুদকের নিষেধাজ্ঞা চ্যালেঞ্জ করা মামলায় রবিবার (৪ এপ্রিল) বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে ১২ পৃষ্ঠার লিখিত রায়ে এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে,আমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে, নাগরিকের চলাফেরার সাংবিধানিক অধিকার কোনও ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের খেয়াল খুশি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ বা বারিত করা অসাংবিধানিক। এটা বাস্তবতা যে, দুর্নীতি কিংবা মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত মামলাসগুলো অনুসন্ধান বা তদন্ত কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যদিওবা সংশ্লিষ্ট বিধিতে অনুসন্ধান বা তদন্তের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। আমাদের বিচারিক অভিজ্ঞতা বলে যে, কমিশন কিংবা অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থা/কর্তৃপক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুসন্ধান বা তদন্ত কার্যক্রম আইন বা বিধিতে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারে না। এটাও বাস্তবতা যে, অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সন্দেহভাজন বা অভিযুক্ত অনেকে বিভিন্ন অজুহাতে দেশ ত্যাগ করছে এবং পরবর্তীতে তাদের আর আইন-আদালতের সম্মুখীন করা সম্ভব হচ্ছে না। এই সব বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে দুর্নীতি বা মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত মামলায়, কিংবা অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রেও অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কোনও ব্যক্তিকে দেশ ত্যাগে বারিত বা তার চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন বা বিধি প্রণয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, যা সময়ের চাহিদাও বটে। সুনির্দিষ্ট আইন বা বিধির অনুপস্থিতিতে কোনও তদন্ত সংস্থার দাতরিক আদেশ দিয়ে এ ধরনের পদক্ষেপ বা কার্যধারা গ্রহণ সংবিধান পরিপন্থী।
রায়ে আদালত আরও বলেন, আমাদের সুস্পষ্ট অভিমত এই যে, অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে দেশ ত্যাগে বারিত (বিরত রাখা) করার প্রয়োজন হলে এ সংক্রান্তে সুনির্দিষ্ট আইন বা বিধি প্রণয়ন এখন সময়ের বাস্তবতা। ওই আইন বা বিধিতে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশ ত্যাগে বারিত করার কারণ জানানো, গৃহীত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির বক্তব্য/আপত্তি প্রদানের সুযোগ রাখতে হবে। অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কারও ওপরে এ ধরনের বিধি নিষেধ আরোপ সংবিধান ও মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ— তাই এর সময়সীমা নির্দিষ্ট করাও ন্যায়সঙ্গত হবে।
আদালত বলেন, অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে যে কোনও অপরাধের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন কোনও ব্যক্তিকে দেশ ত্যাগে বারিত করার জন্য অবিলম্বে প্রয়োজনীয় আইন বা বিধি প্রণয়ন করা দরকার। যতক্ষণ পর্যন্ত এই ধরনের আইন বা বিধি প্রণয়ন করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতের কাছে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার আদেশ প্রার্থনা করা এবং আদলতের অনুমতি গ্রহণ করা।
কোনও ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের খেয়াল খুশি অনুযায়ী নাগরিকের চলাফেরার সাংবিধানিক অধিকার নিয়ন্ত্রণ করা অসাংবিধানিক বলেও অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এর আগে গত ১৬ মার্চ ‘সুনির্দিষ্ট বিধি বা আইন প্রণয়ন না করা পর্যন্ত দুর্নীতি মামলার আসামি বা সন্দেহভাজন কোনও ব্যক্তির বিদেশ যাবার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে দুদক নয়, সিদ্ধান্ত নেবেন বিশেষ জজ আদালত’ মর্মে পর্যবেক্ষণ দেন হাইকোর্ট। বিদেশ যাওয়ায় দুদকের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে নরসিংদীর আতাউর রহমান ওরফে সুইডেন আতাউর রহমানের করা এক আবেদনের ওপর শুনানিকালে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ পর্যবেক্ষণ দেন। হাইকোর্ট বলেন, এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আদেশ দেওয়ার সময় প্রয়োজনীয় গাইডলাইন ঠিক করে দেওয়া হবে। এরই ধারাবাহিকতায় লিখিত রায় প্রকাশ করলেন হাইকোর্ট।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট আতাউর রহমানের সম্পদের তথ্য চেয়ে নোটিশ দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন। এই নোটিশের পর ২২ অক্টোবর তিনি তার সম্পদের তথ্য দুদকে দাখিল করেন। এরপর দুদক অনুসন্ধানে নামে। এই অনুসন্ধানকালে দুদক গত বছরের ২০ ডিসেম্বর আতাউর রহমানের বিদেশ যাবার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) চিঠি দেয়। ওই চিঠির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন আতাউর রহমান। সেই রিটে জারি করা রুল শুনানি নিয়ে গত ১৬ মার্চ রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে ওই চিঠিকে অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
Powered by : Oline IT