পাহাড় কাটার ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ায় কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার হুমকি দিয়েছেন অধিদফতরের কুমিল্লা জেলা উপ-পরিচালককে। গতকাল বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) মোবাইল ফোনে ‘আমার ভালোটা দেখছেন আপনে, খারাপটা তো দেখেন নাই’ বলে হুমকি দেওয়ার পর ওই কর্মকর্তাকে নিজ অফিসে ডেকে ১৫ দিনের মধ্যে কুমিল্লা ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দেন এই সংসদ সদস্য। এসময় পরিবেশ অধিদফতরের স্থানীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ারও হুমকি দেন তিনি। প্রসঙ্গত: পাহাড় কাটার অভিযোগে সড়ক ও জনপদ বিভাগের একটি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করেছিল কুমিল্লা সদর (দক্ষিণ) উপজেলায় পরিবেশ অধিদফতর।
এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের হুমকি দেওয়া দুই মিনিট ১৩ সেকেন্ডের ওই কথোপকথনটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাছে পৌঁছেছে।
৩০ কোটি টাকার কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার বড় ধর্মপুর স্কুলপাড়া এলাকায় পিপুলিয়া-লোলবাড়িয়া-রতনপুর-চন্ডীপুরা-মগবাড়ি সড়ক বর্ধিতকরণ এই প্রকল্পের কাজটি করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেড ও মেসার্স হক এন্টারপ্রাইজ। পরিবেশ অধিদফতর থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে, এই সড়ক প্রশস্ত করার প্রকল্পে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক লাখ ১৪ হাজার ৩৩০ ঘনফুট পাহাড়ি মাটি কেটেছে। কিন্তু তারা পাহাড় কাটার কোনও অনুমতি নেয়নি। আবার সওজ বিভাগও তাদের পাহাড় কাটার বিষয়টি জানা নেই বলে পরিবেশ অধিদফতরকে জানায়। এজন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করে পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রতিবেদন পাঠান কুমিল্লার উপপরিচালক শওকত আরা কলি। এই প্রতিবেদনটি হাতে পেয়েই প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এমপি বাহার। তিনি উপ-পরিচালককে মোবাইল ফোনে কল দেন এবং সেখানে কথোপকথনের সময় ওই হুমকি দেন। কথার একপর্যায়ে উপ-পরিচালককে ১০ মিনিটের মধ্যে তার অফিসে আসার নির্দেশও দেন তিনি। উপপরিচালক কিছুক্ষণ পর তার দুই সহকর্মীকে নিয়ে সংসদ সদস্যের অফিসে যান। সেখানেও এমপি বাহার পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।
পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালককে ফোনে যা বলেছেন এমপি বাহার:
দুই মিনিট ১৩ সেকেন্ডের সেই কথোপকথনে শোনা গেছে:
ডিডি: হ্যালো স্যার, ডিডি পরিবেশ অধিদফতর
এমপি: হ্যাঁ, আপনি যে রিপোর্টটা দিলেন…
ডিডি : স্যার।
এমপি: আপনি যে রিপোর্টটা দিলেন, আপনি আমার সাথে কথা বলেছিলেন? ওই যে লালমাই রাস্তা নিয়ে?
ডিডি: জ্বি স্যার, জ্বি স্যার।
এমপি: রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে নিয়ে দেননি কেন? রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের বিরুদ্ধে লেখেন নাই কেন? আমাদের বিরুদ্ধে লিখলেন কেন?
ডিডি : না না, আমাদের রিপোর্টে রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের বিরুদ্ধেও লেখা হয়েছে স্যার…
এমপি: না না, লেখেননি, আপনার রিপোর্টটা আমার হাতে আছে, আপনার রিপোর্টের ভিত্তিতে আপনি বলেছেন, আমরা এক লাখ ১৪ হাজার ৩৩০ ঘনফুট মাটি কেটে ফেলছি, এই মেজারমেন্টটা আপনি কীভাবে করলেন আমাকে ছাড়া?
ডিডি: স্যার আমরা মেজারমেন্ট…
এমপি: আপনি কীভাবে করলেন আমাকে ছাড়া? আমি তো একটা পক্ষ, আপনি একটা পক্ষ…
ডিডি: স্যার…।
এমপি: আমি ছাড়া আপনি এককভাবে মেজারমেন্ট করলেন কীভাবে? আমার সিগনেচার নেবেন না? ক্ষমতার অপব্যবহার করতেছেন আপনি।
ডিডি : স্যার…।
এমপি: কুমিল্লায় থাইকা ক্ষমতার অপব্যবহার করার কোনও সুযোগ নাই, আমার ভালোটা দেখছেন আপনে, খারাপটা তো দেখেন নাই।
ডিডি : স্যার…।
এমপি: স্যার কী? ননসেন্স কোথাকার? আপনি এটা মেজারমেন্ট করার সময় তো আমাকে রাখতে হবে। আপনি কতটুকু কাটছেন, এটা তো একসাথে মেজারমেন্ট করতে হবে।
ডিডি: স্যার…।
এমপি: খুব ক্ষমতা না? …বলেন না আপনার অনেক ক্ষমতা।… তালা মেরে দেবো অফিসে গিয়ে আমি…বেয়াদব কোথাকার…
ডিডি: না স্যার…।
এমপি: আপনি আমার অফিসে আসেন, ১০ মিনিটের মধ্যে আপনি আমার অফিসে আসেন, কি বলছি বুঝছেন?
ডিডি: কখন আসবো? আজকে স্যার?…
এমপি: ১০ মিনিটের মধ্যে আসেন…১০ মিনিট…১০ মিনিট সময় দিলাম আসেন।
এই কথোপকথনে পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালককে হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটি সরকারি রাস্তা হচ্ছে। সড়ক ও জনপদের অধীনে একটি রাস্তা হচ্ছে। এর কিছু অংশ পাহাড়ে কিছু অংশ পাহাড়ের বাইরে। সড়ক ও জনপদ বিভাগ টেন্ডার দিয়েছে, সেই অনুযায়ী কাজ চলছে। বাংলাদেশের যেখানে পাহাড়ি এলাকায় সড়ক হয়েছে সেখানে পাহাড় কেটেই সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। যেখানে পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সড়ক যাবে, সেখানে পাহাড়ের কিছু অংশ কাটা যাবে এটাইতো স্বাভাবিক। উন্নয়নের কাজে যদি কাটে তাহলে সমস্যাটা কোথায়? পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করার নিয়ম নেই। কিন্তু পাহাড় কেটে তো রাস্তা তৈরি হচ্ছে, হচ্ছে না? এটাকে ভূমি ধস বলা যাবে না। ভূমি ধ্বংস করাও বলা যাবে না। ধ্বংস হবে তখনই যখন মানুষ পাহাড় কেটে নিয়ে ব্যবসা করে।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ইনোসেন্ট উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি সরকারের প্রকল্পে, জনস্বার্থে পাহাড়ে কিছু অংশ দিয়ে সড়কটি যাচ্ছে। এই রাস্তাটা আগেও ছিল, নতুন করে করা হয়নি। এখন শুধু প্রশস্ত করা হচ্ছে। সড়ক ও জনপদ বিভাগের ডিজাইন অনুযায়ী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজটি করছে। তাহলে সড়ক ও জনপদকেও তো রিপোর্ট করা উচিত ছিল। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতর সেটি করেনি। তাই আমি রাগারাগি করছি, যে তোমরা সড়ক ও জনপদকে কেন নোটিশ দাওনি?’
পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালককে দুর্নীতিবাজ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করেছি। দুর্নীতি আমি নিজেও করি না, কেউ দুর্নীতি করলে আমার সহ্য হয় না। এই প্রকল্পের সঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠান জড়িত। পরিবেশ অধিদফতর শুধুমাত্র ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছে। তার মানে এখানে কি অনিয়ম হয়নি? তারা সরকারি কাজে পাহাড় কাটলে মামলা দিতে পারে। কিন্তু বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান যে পরিবেশ আইন না মেনে কতকিছু করছে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিয়েছে? কয়টা ইটভাটা তারা বন্ধ করেছে?
এ সম্পর্কে জানতে পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শওকত আরা কলির সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।
পরে এ বিষয়ে জানতে পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে অফিসিয়ালভাবে কোনও অভিযোগ পাইনি। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ মারফতে জেনেছি। অভিযোগ পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।’
Powered by : Oline IT