রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আট বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। শিশুটির মা-বাবা ভাত-তরকারি বিক্রির ব্যবসা করেন। ঘটনার সময় তার মা-বাবা বাসায় ছিলেন না। প্রতিবেশী চকোলেটের প্রলোভন দেখিয়ে ডেকে নিয়ে যায় বলে থানায় অভিযোগ করেন অভিভাবক।
গত বছর জানুয়ারিতে রাজধানীর ভাটারায় ১১ বছরের একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। শিশুটির মা এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন।
ধর্ষণের এসব ঘটনাসহ গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় রাজধানীর ৫০টি থানায় মামলা হয়েছে ৬১৭টি। এরমধ্যে শিশু-কিশোরী ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২৭৮টি।
ধর্ষণ মামলার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে রাজধানীতে ধর্ষণের ঘটনা কমে আসে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় সাধারণ ছুটি চলাকালে রাজধানীর ৫০ থানায় ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩৪টি। পরবর্তীতে মামলার সংখ্যা বেড়ে যায়। এদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্তের। শিশু নির্যাতন নিয়ে কাজ করে যেমন প্রতিষ্ঠান তারা বলছেন, নিম্নবিত্তের শিশুরা নির্যাতনের শিকার হলে থানায় অভিযোগ করতে যান অভিভাবকরা। তাদের অভিজ্ঞতায় যে পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল না তারা বিচারের দাবি নিয়ে যান ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীকালে সেই মামলা চালিয়ে নিতে সমর্থ হন না। ফলে অপরাধীর পক্ষে আপসের প্রস্তাবে তারা সহজেই সাড়া দেন এবং তা কখনও খুবই স্বল্প অর্থের বিনিময়ে।
অপরদিকে, অপেক্ষাকৃত বিত্তশালীদের পরিবারে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অপরাধ ঘটলেও থানা পর্যন্ত যাওয়ার প্রবণতা কম।
নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশুরা নির্যাতনের শিকার বেশি?
বাসায় অভিভাবক না থাকা, সাবলেট থাকা, প্রতিবেশীর কাছে সন্তান রেখে কাজে যাওয়া, ঘন ঘন প্রতিবেশী পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোর কারণে নিম্নবিত্তের শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয় বেশি। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরাধীরা মনে করে তারা অপরাধ ঘটিয়ে সেটি মীমাংসা করে নিতে পারবে।অথবা মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে সেটি চালিয়ে নেওয়ার সক্ষমতাও থাকবে না ভেবে নেয়।
আট বছরের নুরি। রাজধানীর বাসাবোতে একঘরে মা-বাবা, ভাই, চাচার সঙ্গে বসবাস করতো। মায়ের কাছে সে জানায়, চাচা তাকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে। পরবর্তীকালে মায়ের সঙ্গে আলোচনায় বেরিয়ে আসে ভয়াবহ চিত্র। টানা দুই বছর চাচার দ্বারা প্রতি রাতে যৌন হয়রানির শিকার হয় নুরি। প্রথম দিকে বুঝতে না পারলেও পরবর্তীকালে খারাপ লাগা তৈরি হলে মাকে বিষয়টি জানায় সে।
ব্রেকিং দ্যা সাইলেন্স প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের যৌন হয়রানি বিষয়ে সচেতনতামূলক কাজ করে আসছে। এর প্রধান নির্বাহী রোকসানা সুলতানা বলেন, আমরা বস্তিতে কাজ করি সে জন্যই। তাদের পরিস্থিতির কারণেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে বেশি। তারা কাজে গেলে তাদের শিশুদের প্রলোভন দেখিয়ে নির্যাতনের শিকার বানানো সহজ হয়। বস্তির ৯৫ শতাংশ শিশু কোনও না কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে বড় হচ্ছে। ধর্ষণের আগে যৌন হয়রানিমূলক যে অপরাধের স্তরগুলো সেগুলো কেউ আমলে নিতে চায় না। ধর্ষণ হলে কেবল আমাদের নোটিশে আসে। নিম্নবিত্তের শিশু একই ঘরে চাচা ফুফু মা-বাবার সঙ্গে বাস করে। এবং সেই পরিস্থিতিতে শিশু ও কিশোরীরা নির্যাতনের শিকার হয়।
রোকসানা সুলতানা বলেন, উচ্চবিত্তের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় কম, যৌন হয়রানির শিকার হয়। তাদের বাসা ও জীবনযাপনের ধরনের কারণে ধর্ষণের ঘটনা ঘটার সুযোগ কম। কিন্তু পরিবারের নিকটজনের মাধ্যমে যৌন হয়রানির ঘটনা মোটেই কম না। আর নিম্নবিত্তের ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ হয় বেশি। কেননা, তারা থানায় অভিযোগ নিয়ে যায়। তারা বিচারটা চাইতে জানে। উচ্চবিত্তের মধ্যে রাখঢাকের প্রবণতা বেশি আর মধ্যবিত্তের প্রকৃত চিত্রতো দেখাই যায় না।
উচ্চবিত্তের নির্যাতনের অভিযোগ প্রবণতা কম
ব্যাংকার বাবার মেয়ে সীমা (ছদ্মনাম)। মা বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা ছিলেন। ২১ বছর বয়সে এসে মেয়ে প্রথম তার মায়ের কাছে শিশুকালে ঘটে যাওয়া তার যৌন হয়রানির কথা জানায়। নিজের মামা কীভাবে ১২ বছর বয়সে তাকে যৌন হয়রানি করে, সে বিবরণ মাকে নির্বাক করে তোলে। ছোট খালা সে সময় কাউকে বলতে দেয়নি। সে সময় টানা ছয় মাস নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল মেয়েটি।
ধর্ষণের মতো অপরাধ যতক্ষণ না কোনও মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত উচ্চবিত্ত নিজে থেকে তা প্রকাশ করতে আগ্রহী না উল্লেখ করে নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, উচ্চবিত্ত বিচারের থেকে সমাজে তার অবস্থান টলে যাবে কিনা সেই শঙ্কায় থাকে। নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতার জন্য সেই নারীটি যে দায়ী নয় সেটি তাদের মানসিকতায় ঢোকেনি। অশিক্ষিত, দরিদ্র, তথাকথিত কম বুঝা মানুষগুলোকে সচেতনতা প্রকল্পাধীন করায় বড় ধরনের গ্যাপ তৈরি হয়েছে।
বিচারের প্রতি সচেতনতা নয়, আর কিছু করার নেই ভেবে নিম্নবিত্তের ভিকটিম থানা পর্যন্ত যায় উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান মনে করেন, উপসংহার টানার সময় এখনও আসেনি। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নিম্নবিত্তের মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে করছে এমন না। তারা আর কিছু করার নাই, অসহায়ত্বের জায়গা থেকে হাজির হয়। যেহেতু ঘটনা ঘটলে তাদের গোপন রাখার পথ থাকে না। আবার আপসের আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকেও যায়। তবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে চলমান অপরাধ থেকে অভিযোগ না আসাটা অ্যালার্মিং উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমাজবিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে আমরা আশপাশে এ ধরনের লুকানো অনেক ঘটনা জানতে পাই, যা কিনা নথিভুক্ত হচ্ছে না। পারিবারিক সামাজিক অনিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর অভাব আছে বলে নিম্নবিত্তের শিশুরা সহজেই শিকার হচ্ছে। তবে যে মামলা নথিভুক্ত সেগুলোর শেষটা কী হচ্ছে সেই তথ্য পাওয়া গেলে পুরো চিত্রটা স্পষ্ট হতো।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) শাহ আবিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রাজধানীতে ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে যে সব সময় নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ বা মামলা করে থাকেন বিষয়টা এমন না। আমরা মনে করি, যারাই ভিকটিম হয়ে থাকেন তারাই আইনের আশ্রয় নেন। আর এটা তাদের অধিকার। তবে এমন থাকতে পারে, ঘটনার পর সংকোচ না করে দ্রুতই অভিযোগ বা মামলা করেন। আবার অনেকে পরে করেন। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, তবে ঢালাওভাবে এভাবে বলা ঠিক হবে না। সব মামলার পরিসংখ্যান দেখতে হবে। আবার এমন ভিকটিমও পেতে হবে, যারা আইনের আশ্রয় নেননি।
Powered by : Oline IT